Monday, May 2, 2016

বিবর্ণ সাকিবে বাড়ছে দুশ্চিন্তা

বিবর্ণ সাকিবে বাড়ছে দুশ্চিন্তা
হিলোটা কী সাকিব আল হাসানের? এবারের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) বিস্ময়ের ফুল ফোটাচ্ছেন বাংলাদেশ সতীর্থ মুস্তাফিজুর রহমান। তাঁর জাদুকরী বোলিংয়ে রীতিমতো মুগ্ধ সমকাল। অনেকে তো মহাকালের এক কিংবদন্তি হওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেখছেন ২০ বছরের এই তরুণের পারফরম্যান্সে। টুর্নামেন্টে তাই ‘বাংলাদেশের পোস্টারবয়’ এই বাঁহাতি পেসার, অনেক দিন ধরেই যেটি ছিল সাকিবের একক অধিকার। কিন্তু এবার মুস্তাফিজের আলোকিত পারফরম্যান্সের বিপরীতে বুঝি বা অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছেন পূর্বসূরি। সাতরঙা রংধনুর সামনে যেন পরিণত রংহীন এক তারকা। ঠারেঠোরে ওঠা প্রশ্নটি তাই সময়ের সঙ্গে জোরালো হচ্ছে ক্রমেই—হলোটা কী সাকিবের? আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডারসের (কেকেআর) ঘরের ছেলে তিনি অনেক দিন ধরে। ২০১২ ও ২০১৪ সালে শিরোপা জয়ে রাখেন বড় ভূমিকা। অথচ সেই সাকিবকে কিনা এবারের প্রথম দুটি ম্যাচে একাদশেই রাখা হয় না! এরপর মাঠে ফেরেন ঠিকই, কিন্তু নিজেতে ফিরতে পারেন না। চার ম্যাচে ৬.৬৬ গড়ে সাকল্যে ২০ রান এবং ৪৫ গড়ে দুই শিকার দেয় সেই সাক্ষ্য। কাল তাই আবার ঠিকানা সাইড বেঞ্চে; তাঁর জায়গায় বরং ৪৫ বছরের ‘বুড়ো’ ব্রাড হগে আস্থা কলকাতার দলটির। এই দুঃসময়ে সাকিবকে নিয়ে দুশ্চিন্তার চোরা স্রোতের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্দরমহলে। আর চলছে সেই প্রশ্নটির উত্তরের সুলুকসন্ধান। বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্টের ন্যাশনাল ম্যানেজার নাজমুল আবেদীন সাকিবকে চেনেন সেই ছোট্টটি থেকে। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রিয় শিষ্যের বোলিংয়ে খুব একটা সমস্যা দেখছেন না তিনি, তবে ব্যাটিংয়ের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়া ভাবাচ্ছে খুব, ‘সাকিবের বোলিং প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানরা এখনো সমীহ করে। তবে ব্যাটিংশক্তিটা সীমিত হয়ে গেছে খুব।’ বলে সেটি আরো ব্যাখ্যা করেন নাজমুল, ‘আসলে কয়েকটি শটে ও সব সময় রান করে এসেছে। অফ সাইডে কাট, লেগ সাইডে স্লগ সুইপ আর পুল—এগুলো ওর স্কোরিং শট। কিন্তু এখন তো সব বোলারই ব্যাটসম্যানদের নাড়িনক্ষত্র বের করে ফেলে। তাই ওই কয়েকটি শট দিয়ে বিশেষত টি-টোয়েন্টিতে সাকিবের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন।’ সাকিবের আশৈশবের আরেক কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের বিশ্লেষণও অভিন্ন। বোলিং নিয়ে নিরুদ্বেগ থাকলেও ব্যাটিং নিয়ে অন্তহীন উদ্বেগের আঁচ পাওয়া যায়, ‘যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে ইনডোরে বোলিং নিয়ে এক দিন কাজ করেছে। অন্যরা তো শুধু উইকেট দিয়ে বোলারকে বিবেচনা করে। কিন্তু আমি কোচের চোখ দিয়ে দেখে বুঝতে পারি, সাকিবের বোলিং ছন্দ একেবারে ঠিক আছে। উইকেট পাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার। তবে ব্যাটিং নিয়ে অমনটা আমি বলতে পারছি না।’ জাতীয় দলের সাবেক সহকারী কোচ সাফল্যের জন্য শিষ্যের শটের বহর বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন, ‘ব্যাটিংয়ে প্রিডিটারমাইন্ড শটে আগে ও প্রচুর রান করেছে। এখন আর সেটি হচ্ছে না। আগের মতো খেলতে গেলেই আউট। প্রতিপক্ষ ওকে নিয়ে কাটাছেঁড়া করে দুর্বলতা বের করে ফেলেছে। এখন তাই সাকিবের নতুন নতুন শক্তির জায়গা বের করতে হবে। বাড়াতে হবে শটের বহর।’ একই কথা নাজমুলেরও, ‘টি-টোয়েন্টিতে ভালো ব্যাটিং করতে হলে সাকিবের শটের রেঞ্জ বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প আমি অন্তত দেখছি না।’ কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এক দশক কাটিয়ে দেওয়ার পর এখন নতুন করে শটের বহর বাড়ানো কি সম্ভব? সালাউদ্দিন তা অসম্ভব মানছেন না, ‘আগে সাকিবের প্রয়োজন হয়নি বেশি শট খেলার; অল্প শটেই অনেক রান করেছে। এখন যখন প্রয়োজন, তখন নতুন নতুন শট যোগ করার চ্যালেঞ্জ ওর সামনে। সব ক্রীড়াবিদের ক্যারিয়ারেই কিন্তু এমন সময় আসে। যারা সেই চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে পারে, তারা বড় স্পোর্টসম্যান। আমি বিশ্বাস করি, সাকিবও তা পারবে।’ ফর্মের চূড়া থেকে নেমে যাওয়া শিষ্যের প্রতি বিশ্বাসের পাহাড় টলেনি নাজমুলেরও, ‘সাকিবের বয়স এখন কত? ২৮-২৯ বছর। আমি বিশ্বাস করি, ওর সেরা সময় সামনে পড়ে আছে। খেয়াল করে দেখুন, পাঁচ বছর আগে ও যেমন খেলত, এখন তার চেয়ে অনেক পরিণত। এখন যে রান করতে পারছে না, এই শিক্ষাটা কাজে লাগিয়ে যদি নতুন নতুন শটে মনোযোগী হয়, সাকিব সামনে আরো অনেক ভালো করবে।’ ২০০৬ সালের আগস্টে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। ২০০৭ বিশ্বকাপ থেকেই দলের অপরিহার্য অংশ। এরপর সময় যত এগিয়েছে, পাল্লা দিয়ে ভালো হয়েছে সাকিবের পারফরম্যান্স। বাংলাদেশের জার্সির পাশাপাশি তাই ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও দাপিয়ে বেড়ান ক্রিকেটের গ্রহজুড়ে। কিন্তু এবারের আইপিএলে যে তিনি দাপট হারিয়ে গড়পড়তা একজন! এমন দুঃসময় খুব একটা আসেনি সাকিবের ক্যারিয়ারে। গাজী গ্রুপ ক্রিকেটারসের বর্তমান ডিরেক্টর অব কোচিং সালাউদ্দিন সমস্যা মানছেন সেটিকেও, ‘মনে রাখতে হবে, ও জীবনে এমন পরিস্থিতিতে পড়েনি। এমন বাজে ফর্মের সময় কী করতে হয়, তা জানে না। এ জন্য সাকিবকে আরো বেশি এলোমেলো লাগছে।’ ফর্মের এই চোরা চক্কর থেকে বেরোনোয় শিষ্যের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি, ‘প্রত্যেক বড় খেলোয়াড়ের জীবনে এমন পর্যায় আসে। তাদের পারফরম্যান্সের গ্রাফ শুরুর দিকে কেবল ওপরেই উঠতে থাকে। উঠতে উঠতে একটা জায়গায় এসে থমকে যেতে বাধ্য। সাকিবের বেলায়ও হয়েছে ঠিক তা-ই। এখন এখান থেকে বেরোতে হবে ওর নিজের চেষ্টায়।’ সেটি পারলে চ্যাম্পিয়নের মালাটি আরো একবার শিষ্যের গলায় উঠবে বলে আশাবাদী সাকিবের বিকেএসপির কোচ নাজমুল, ‘বড় বড় ক্রীড়াবিদরা ব্যর্থ হলে নতুন করে অনুপ্রাণিত হয় সাফল্যের জন্য। আশা করি, সাকিবেরও তা-ই হবে। আবার সফল হলে তাহলেই না ও চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার!’ সেই চ্যাম্পিয়ন সাকিবের ফিরে আসার অপেক্ষায় এখন পুরো বাংলাদেশ। সামর্থ্যের মরচে ধরা নিয়ে ওঠা সব প্রশ্নের জবাবের প্রতীক্ষায়ও। কারণ এবারের আইপিএল সাকিবের ‘শেষের শুরু’ হিসেবে চিত্রিত হোক তাঁর ক্যারিয়ার গ্রাফে—সেটি যে চায় না এই ক্রিকেট মানচিত্রের কেউ!
info
www.kalerkantho.com

No comments:

Post a Comment