ব্যাটসম্যানের জীবনটা ১ বলের, সে তিনি স্যার ডন ব্র্যাডম্যান হন কি নিখাদ টেলএন্ডার। তবু কারো কারো ব্যাটের দিকে তাকিয়ে থাকে তাঁর দল। বিরাট কোহলি আর ক্রিস গেইলের ব্যাটের দিকে তো আজ তাকিয়ে থাকবে ক্রিকেট বিশ্বই। সামর্থ্য আর ফর্ম দিয়েই ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেমির ফোকাসটা নিজেদের ওপর ধরে রেখেছেন তাঁরা। ছবি : এএফপি
আগেরবার তবু মেনে নিয়েছিলেন ড্যারেন সামি। মেনে নিয়েছিলেন বাংলাদেশে হওয়া ২০১৪-র বিশ্বকাপ খেলেই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিকে বিদায় জানাতে যাওয়া কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনের কথা ভেবে। সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে হারের পর তাঁকে ছুঁয়ে যাওয়া বিষাদ লুকিয়েও তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক সান্ত্বনা খুঁজেছিলেন এভাবে, ‘আমার ধারণা আজ সর্বশক্তিমানও চেয়েছেন তাঁরা যেন ভালোভাবে শেষ করতে পারেন। সেজন্য আরো একটি ম্যাচ তাঁরা পাচ্ছেন। এই ম্যাচে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ করার কারণ সম্ভবত এটিই।’
২০১২-র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক এবার নিশ্চিতভাবেই ঈশ্বরের আনুকূল্য চাইবেন। চাইবেন যেন বিশ্বজয়ের স্বাদ নিয়েই শেষ করতে পারেন তাঁর মতো এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের আরো অনেকেই। নাহ্, সহসাই এঁদের কারো অবসরে যাওয়ার ঘোষণা এখন পর্যন্ত আসেনি। কিন্তু নতুন নিয়মে যে এখন থেকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হবে চার বছর পর পর। সেই হিসাবে ২০২০ সালে পরের আসরের আগে এই ক্যারিবীয় দলের অনেকেরই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। তাই এই ‘শেষ সুযোগ’ কাজে লাগাতে মরিয়া সামিরা। কিন্তু শিরোপা জিতে ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিকে বিদায় দেওয়ার জন্য ভারতীয় খেলোয়াড়দেরও কম মরিয়া হয়ে থাকার কথা নয়। শিগগিরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর না নিন, নিশ্চিতভাবেই পরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলছেন না ‘এমএসডি’!
কাজেই আজ মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মুখোমুখি হতে যাওয়া দুই দলেরই অভিন্ন লক্ষ্য। সাফল্য দিয়ে তাঁদের কারো কারো বিদায় রাঙিয়ে দেওয়ার পথে আরো এক ধাপ এগোনোর স্বপ্নে ‘প্রাণ’ এনে দিচ্ছে প্রথম দল হিসেবে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার হাতছানিও। যদিও নিজেদের মাঠ এবং বিপুল দর্শক সমর্থনের সুবিধা নিয়ে ফাইনালের লড়াই শুরুর আগে সাফল্যের হার এগিয়ে রাখছে ভারতকেই। এর আগে দুইবার সেমিফাইনাল খেলা ভারত হারেনি কোনোবারই। ২০০৭ সালের চ্যাম্পিয়ন ভারত গত আসরে ফাইনালে হেরেছিল শ্রীলঙ্কার কাছে। আজ তাদের সেমিফাইনাল পরিসংখ্যান আরো হূষ্টপুষ্ট হবে নাকি ক্যারিবীয়রা গতবার শেষ চার থেকে বিদায় নেওয়ার দুঃখ ভুলে ফাইনালে যাবে, তার মীমাংসায় দুজনের ব্যাটই নিয়ামক হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে।
এঁদের একজন ব্যাটে দানবীয় শক্তির সঞ্চার করতে জানা ক্রিস গেইল ক্যারিবীয় সাফল্য চিন্তার মধ্যমণিও। আর ভারতের স্বপ্ন আবর্তিত হচ্ছে এই আসরে কঠিন পরিস্থিতিতেও দারুণ ব্যাটিংয়ে ম্যাচ বের করে আনা বিরাট কোহলিকে ঘিরে। দৈত্য-দানবের শক্তি যদি গেইলের মূল ভরসা হয়, তাহলে চূড়ান্ত ক্রিকেটীয় দক্ষতার মানবীয় প্রকাশ কোহলির ব্যাটে। কিন্তু সেমিফাইনালের আগে এঁদের নিয়ে আলোচনায় আড়ালে চলেও গেলেও দুই দলেই এমন আরো অনেকে আছেন, যাঁরা ব্যাটিং কিংবা বোলিংয়ে দিব্যি ম্যাচ ভাগ্য গড়ে দিতে জানেন। ভারতের কথাই ধরা যাক। রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান কিংবা সুরেশ রায়নারা তো এখনো চেনা চেহারায় দেখাই দেননি। কে জানে সেরাটা তাঁরা সেমিফাইনালের জন্যই জমিয়ে রেখেছেন কিনা! টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী অবশ্য তাঁদের নিষ্প্রভতার দিকে ইঙ্গিত করেই বলেছেন, ‘এই টুর্নামেন্টে আমরা আমাদের সামর্থ্যের ৭০ ভাগই মাত্র এখন পর্যন্ত খেলতে পেরেছি। এখনো উন্নতি করার যথেষ্ট সুযোগ আছে আমাদের। আশা করব সেটি কালই (আজ) হবে। আশা করব এটিও ঘটবে দেখব যে এক-দুজনের ওপর নির্ভর না করে দলের ছয়-সাতজন পারফর্ম করছে। টুর্নামেন্টে এই ব্যাপারটিও তো আমরা এখন পর্যন্ত ঘটতে দেখিনি।’
কোহলি নির্ভরতা কমিয়ে আনার দাবি শাস্ত্রীর। আবার ক্রিস গেইলকে সতীর্থরা ‘দ্য ইউনিভার্স বস’ বলে মানলেও ক্যারিবীয়রা শুধু তাঁর ওপরই নির্ভরশীল নয়। চোটের কারণে ছিটকে পড়া আন্দ্রে ফ্লেচার শ্রীলঙ্কা ম্যাচে সেটি ভালোমতোই বুঝিয়েছেন। গোড়ালির চোটে নাকাল যুবরাজ সিংয়ের জায়গায় একাদশে কাকে খেলানো যায় তা নিয়ে যখন ভারত অধিনায়ক ধোনি আর শাস্ত্রীর মধ্যে টানাপড়েনের খবর ছড়িয়ে পড়েছে, তখন ক্যারিবীয়রা সম্ভাব্য জম্পেশ লড়াইয়ে নিজেরা বাজিমাত করার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে আছে। যে স্বপ্নে অন্য আর কিছুই আঁচড় কাটতে পারছে না। দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় তাঁরা এমনই অটল যে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে অনাহূতের মতো খেলতে নামার ব্যাপারটি তুলেও বিচলিত করা গেল না সামিকে, ‘লড়াইটা হবে ১৫ জন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান আর কয়েক বিলিয়ন ভারতীয়র। আমরা এই চ্যালেঞ্জটির জন্য তৈরিও। যে কাউকেই ফল অনুমান করতে দিন না কেন, সে-ই ভারতের পক্ষে ৮০-২০ বলবে। যা অনেকটা ডেভিড আর গোলিয়াথের মতোই অনেকটা। কিন্তু লোকজন ভুলে যেতে চায় যে লড়াইয়ে কিন্তু ডেভিডই জিতেছিল।’ ভারতকে এখানে পরাক্রমশালী ‘গোলিয়াথ’ বলেই মেনে নেওয়া সামির খুদে ‘ডেভিড’-এর শক্তিতেই জ্বলে উঠতে চাওয়ার তাড়না আরো বেশি এ কারণে, ‘‘আমাদের দলের বেশ কয়েকজনই এখন মধ্য ত্রিশে। পরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চার বছর পর। তত দিনে ‘দ্য ইউনিভার্স বস’-এর বয়স হবে ৪০, আমার ৩৬। এরকম কয়েকজন খেলোয়াড়ের জন্যই আমরা এই বিশ্বকাপটি জিততে চাই।’’
কিন্তু চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মিলতে ঈশ্বরের আনুকূল্যও তো পাওয়া চাই। ঈশ্বরভক্ত সামি গতবার যা পেতে দেখেছেন সাঙ্গাকারা-জয়াবর্ধনেদের। এবার তাহলে কার পালা? গেইল-সামিদের নাকি ধোনির? ঈশ্বরের মনোভাব আগাম জানার উপায় নেই বলে আপাতত উত্তর জানার চেষ্টা না করে ক্রিকেটীয় দক্ষতার চরম প্রকাশে জমজমাট এক ম্যাচই দেখার আশা করা যাক না!
No comments:
Post a Comment